বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ (সরল গদ্যরূপ)
বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ (সরল গদ্যরূপ)
রাম লঙ্কা আক্রমণ করেছে। লঙ্কার রাজা রাবণ শত্রুর উপর্যুপরি দৈব-কৌশলের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন। ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ ও পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুর পর মেঘনাদকে পরবর্তী মহাযুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে বরণ করে নেয় রাবণ। যুদ্ধজয় নিশ্চিত করার জন্য মেঘনাদ যুদ্ধযাত্রার আগে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ইষ্টদেবতা বৈশ্বানর বা আগুন দেবতার পূজা সম্পন্ন করতে মনস্থির করে।
মায়া দেবীর আনুকুল্যে এবং রাবণের অনুজ বিভীষণের সহায়তায়, লক্ষ্মণ শত শত প্রহরীর চোখ ফাকি দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশে সমর্থ হয়। কপট লক্ষ্মণ নিরস্ত্র মেঘনাদের কাছে যুদ্ধ প্রার্থনা করলে মেঘনাদ বিস্ময় প্রকাশ করে। শত শত প্রহরীর চোখ ফাকি দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণের অনুপ্রবেশ যে মায়াবলে সম্পন্ন হয়েছে, বুঝতে বিলম্ব ঘটে না তার। ইতোমধ্যে লক্ষ্মণ তলোয়ার কোষমুক্ত করলে মেঘনাদ যুদ্ধসাজ গ্রহণের জন্য সময় প্রার্থনা করে লক্ষ্মণের কাছে। কিন্তু লক্ষ্মণ তাকে সময় না দিয়ে আক্রমণ করে। এসময়ই অকস্মাৎ যজ্ঞাগারের প্রবেশদ্বারের দিকে চোখ পড়ে মেঘনাদের, দেখতে পায় বীরযোদ্ধা পিতৃব্য বিভীষণকে। মুহুর্তে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায় তার কাছে!
'এতক্ষণে'- বলে ওঠে মেঘনাদ বিষাদমাখা স্বরে,
'এতক্ষণে বুঝলাম কেমন করে লক্ষণ এই রাক্ষসপুরীতে এলো, কীভাবে অনুপ্রবেশ করল এই নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে! হায়, চাচাজি! আপনার মাতা নিকষা সতী, ভ্রাতা ত্রিশূল হাতে মহাদেবের ন্যায় কুম্ভকর্ণ, ভাইয়ের ছেলে ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ, আপনার কি উচিত এই কাজ? নিজের ঘরে চোর এনে ঢোকালেন? চন্ডালকে বসালেন রাজার আসনে? কিন্তু আপনাকে তিরস্কার করবনা, আপনি গুরুজন, আমার পিতার মতো! দরজা থেকে সরে দাড়ান, আমি অস্ত্রাগারে যাব, পাঠাব লক্ষ্মণকে যমালয়ে! লঙ্কার কলঙ্ক আজকে ধূলিসাৎ করব এই যুদ্ধে!'
বিভীষণ উত্তর দিল, বৃথা চেষ্টা করছ তুমি মেঘনাদ! তুমি তো বুদ্ধিমান। আমি রামের দাস। কি করে তার বিরুদ্ধে কাজ করব? কি করে তোমার অনুরোধ রক্ষা করব?
মেঘনাদ কাতরে উঠে উত্তর দিল, 'চাচাজি, আপনার কথা শুনে মরে যেতে ইচ্ছা করছে! রামের দাস আপনি? আমাকে বলুন,কিভাবে এই কথা আপনি মুখে আনলেন! বিধাতা যে চাঁদকে ওই আকাশে স্থাপন করেছেন, তা কি মাটিতে নেমে ধূলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে? হে বীর, কিভাবে ভুলে গেলেন আপনি কে, আপনার জন্ম কোন কূলে?! কে ওই অধম রাম? রাজহাঁস তো সচ্ছ সরোবরের পদ্মফুলের বনে খেলা করে, সে তো যায়না কোনো পচা ডোবায়,কোনো বদ্ধ জলাশয়ে! সিংহের ন্যায় বীর আপনি,বলুন তো, সিংহ কি কখনো শেয়ালকে বন্ধু ভেবে সম্ভাষণ করে? আমি অজ্ঞ, আপনি জ্ঞানী, আপনার তো সবই জানা! এই লক্ষণ নীচ,ক্ষুদ্র,হীন! নাহলে সে অস্ত্রহীনের সাথে যুদ্ধ করে কী করে? বলুন হে মহারথী, মহাবীর, এটা কি মহাবীরের মতো আচরণ? লঙ্কাতে এমন শিশু খুজে পাওয়া যাবে না এই কথা শুনে যে হাসবে না! পথ ছাড়ুন,এখনি ফিরে আসব! আজকে দেখব কোন দৈববলে লক্ষ্মণ আমার সাথে যুদ্ধে যেতে! দেব-দৈত্য-নর সবার সাথে যুদ্ধে আমার পরাক্রম তো আপন চাক্ষুষ দেখেছেন! কী দেখে এই পরাক্রমশালী ভয় পাবে এই দুর্বল মানুষের? নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে দম্ভের সাথে এসে ঢুকল এই দাম্ভিক, আদেশ করুন,একে শাস্তি দিই! আপনার জন্মভূমিতে বনবাসী প্রবেশ করে! সে বিধাতা! স্বর্গের উদ্যানে দুরাচারী দৈত্য! ফুলের বাগানে কীট! বলুন চাচাজি, এ অপমান সহ্য করব কেমন করে? আমি যে আপনার ভাইয়ের ছেলে। আপনিও কেমন করে সহ্য করছেন!'
মহামন্ত্র শুনে সাপ যেমন মাথা নত করে,তেমনি মাথা নীচ করে, লজ্জায় মুখ কালো করে, মেঘনাদের দিকে তাকিয়ে রাবণের সহোদর বিভীষণ বলেন, 'আমি দোষী নই,পুত্র! আমাকে বৃথায় তিরস্কার করছ তুমি! নিজ কর্ম দোষে, হায়, এই লঙ্কা আর নিজের বিপদ ডেকে আনল এই লঙ্কারই রাজা! দেবকুল পাপ থেকে বিরত। এমন পাপপূর্ণ লঙ্কা, পৃথিবীর মতো প্রলয়ের দিকে যাচ্ছে এই পাপের জন্য! তাই রামের পায়ে আশ্রয় নিয়েছি আমি। পরের দোষে কে বিপদে পড়তে চায়?'
মেঘনাদ রেগে গেল। নিকষ কালো অন্ধকার রাতে মেঘ যেমন গম্ভীর আওয়াজ করে,তেমতি গম্ভীর স্বরে বলল, 'ধর্মের অনুসারী আপনি, ধার্মিক বলে জগৎজোড়া খ্যাতি আপনার হে রাক্ষসরাজের ভাই! কোন ধর্ম মতে, বলুন আমাকে, আত্মিয়তা, ভ্রাতৃত্ব, জাতি-এই সব জলাঞ্জলি দিলেন আপনি? শাস্ত্রে বলে, পর যদি গুণবান হয় আর স্বজন যদি গুণহীন হয়, তাও নির্গুণ স্ব্জনই শ্রেয়! পর তো সর্বদাই পর! এ শিক্ষা, হে মহাবীর, কোথায় শিখলেন? কিন্তু বৃথায় তিরস্কার করি আপনাকে, বর্বরতা কেন শিখবেন না? যার সঙ্গী নীচ, হীন, সে নিজেও তেমনি!
MD. Shafin Zaman
Notre Dame College
Dhaka
HSC 2022
Comments
Post a Comment